শেয়ার বাজার

ইসলামি শরিয়তে তৃতীয় লিঙ্গের পরিচয় ও বিধান

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: মঙ্গলবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৪

ইসলামি শরিয়তে তৃতীয় লিঙ্গের পরিচয় ও বিধান

JlecBD ডেস্ক: যেসব মানুষের পুলিঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গ উভয়টিই রয়েছে অথবা কোনোটিই নেই, ইসলামে তাদের খুনসা বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ বলা হয়। অর্থাৎ একই শরীরে নারী ও পুরুষ উভয় বৈশিষ্ট্য থাকলে বা কোনো লিঙ্গবৈশিষ্ট্য না থাকলে তারা ইসলামে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ বিবেচিত হয়।

ইসলামি শরিয়তে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়:

এক. পুরুষ তৃতীয় লিঙ্গ

তৃতীয় লিঙ্গের যেসব মানুষের মধ্যে পুরুষ বৈশিষ্ট্য প্রবল থাকে ইসলামে পুরুষ গণ্য করা হয়। যেমন দাড়ি-গোঁফ গজানো, নারী সহবাসে সক্ষমতা, স্বপ্নদোষ হওয়া ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য পাওয়া গেলে তাকে পুরুষ গণ্য করা হয় এবং পুরুষের যাবতীয় বিধিবিধান তার ব্যাপারে প্রযোজ্য হয়। যেমন নারীর সাথে তার বিয়ে বৈধ হয়, পুরুষের সাথে অবৈধ হয়, নারীর সাথে পর্দা জরুরি হয় এবং মিরাসের সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে তাকে পুরুষ বিবেচনা করে সম্পদ বণ্টন করা হয়।

দুই. নারী তৃতীয় লিঙ্গ

তৃতীয় লিঙ্গের যেসব মানুষের মধ্যে নারী বৈশিষ্ট্য প্রবল তাকে নারী গণ্য করা হয়। যেমন যেসব হিজড়ার স্তন, ঋতুস্রাব, সহবাসের উপযোগিতা, গর্ভ সঞ্চার হওয়া ইত্যাদি নারী বৈশিষ্ট্য থাকে, ইসলামে তাদের নারী গণ্য করা হয় এবং নারীদের যাবতীয় বিধিবিধান তার ব্যাপারে প্রযোজ্য হয়। যেমন পুরুষের সাথে তার বিয়ে বৈধ হয়, নারীর সাথে অবৈধ হয়, পুরুষের সাথে পর্দা জরুরি হয় এবং মিরাসের সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে তাকে নারী বিবেচনা করে সম্পদ বণ্টন করা হয়।

তিন. জটিল তৃতীয় লিঙ্গ

তৃতীয় লিঙ্গের যেসব মানুষের মধ্যে নারী-পুরুষের কোনো বৈশিষ্ট্যই পরিলক্ষিত হয় না অথবা উভয় ধরনের বৈশিষ্ট্য সমানভাবে পরিলক্ষিত হয়, তাদের শরিয়তের পরিভাষায় খুনসায়ে মুশকিলা বা জটিল তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ গণ্য করা হয়। তাদের ব্যাপারে শরিয়তের নির্দেশনা হলো ভালোভাবে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বিভিন্ন চিহ্ন বা আলামতের ভিত্তিতে তাকে পুরুষ বা নারী শ্রেণিভুক্ত করার সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। সাধারণত যে কোনো দিকে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য প্রবল হয়।

যদি তৃতীয় লিঙ্গের বিরল কোনো মানুষকে কোনোভাবেই কোনো একটি শ্রেণিভুক্ত করা না যায়, তাহলে চিকিৎসার মাধ্যমে নারী বা পুরুষের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হওয়ার চেষ্টা করা তার জন্য জায়েজ। চিকিৎসা নেওয়ার পর শরীরে প্রকাশিত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী তাকে পুরুষ বা নারী বিবেচনা করা হবে। এর আগ পর্যন্ত পর্দা ও বিয়ের ক্ষেত্রে তার ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। অর্থাৎ পুরুষরা তাকে নারী ও নারীরা পুরুষ বিবেচনা করবে। উত্তরাধিকারের সম্পত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে যদি নারী ও পুরুষ হিসেবে সে সমান সম্পত্তির অধিকারী হয়, তাহলে ওই পরিমাণ সম্পত্তি তাকে দিতে হবে। যদি নারী বা পুরুষ হিসেবে ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণ সম্পত্তির অধিকারী হয়, তাহলে তাকে যে লিঙ্গের বিবেচনা করলে সে তুলনামূলক কম সম্পত্তি পাবে, তাকে ওই লিঙ্গের বিবেচনা করে সম্পত্তি বণ্টন করতে হবে।

Dummy Ad 1

রোজা যেভাবে ইসলাম ধর্মের পাঁচ ফরজের একটি হয়ে উঠল

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২৮ মার্চ, ২০২৩

রোজা যেভাবে ইসলাম ধর্মের পাঁচ ফরজের একটি হয়ে উঠল

ইসলামের নবী নিজে মাঝে মাঝে রোজা রাখলেও শুরুর দিকে উম্মত বা সাহাবীদের জন্য, বিশ্বাসীদের জন্য ৩০ রোজা রাখার বিষয়টি বাধ্যতামূলক ছিল না। ইসলামে রোজা বা রমজান ফরজ হিসাবে বাধ্যতামূলক করা হয় হিজরি দ্বিতীয় বর্ষে। এরপর থেকেই অপরিবর্তিত রূপে সারা পৃথিবীতে রোজা পালন করা হচ্ছে রমজানের মতো না হলেও ইহুদি এবং অন্যান্য আরও অনেক জাতিগোষ্ঠীর মধ্যেও রোজার মতো সারাদিন পানাহার না করার ধর্মীয় রীতি দেখা যায় তবে ইসলামের প্রধান পাঁচটি ধর্মীয় স্তম্ভের একটি হচ্ছে রোজা। অন্য চারটি ফরজ হচ্ছে ঈমান, নামাজ, যাকাত, হজ্জ।

কখন ও কীভাবে রোজা ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হয়ে উঠলো?

মক্কা-মদিনায় আগে থেকেই ছিল রোজার রীতি যে বছর রোজা ফরজ করা হয়েছিল, তার দুই বছর আগে ৬২২ খৃষ্টাব্দে মক্কা থেকে সাহাবীদের নিয়ে মদিনায় হিজরত করেন ইসলামের নবী। হিজরতের তারিখ থেকে মুসলিমদের হিজরি সাল গণনা শুরু করা হয়। হিজরি দ্বিতীয় বছরে রমজান মাসে রোজা রাখা বাধ্যতামূলক বা ফরজ ঘোষণা করে আয়াত নাজিল হয় বলে ইসলাম বিশেষজ্ঞরা বলছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী শিক্ষা বিভাগের অধ্যাপক ড. শাসুল আলম বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘’কোরানে যে আয়াত দিয়ে রোজা ফরজ করা হয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে যে, পূর্ববর্তী জাতিসমুহের ওপরেও রোজা ফরজ ছিল।"

"তার মানে এটা বোঝা যায় যে, আগে থেকেই বিভিন্ন জাতির মধ্যে রোজা রাখার চল ছিল, যদিও সেটার ধরন হয়তো আলাদা ছিল। যেমন ইহুদিরা এখনো রোজা করে, অন্যান্য জাতির মধ্যেও এ ধরনের রীতি আছে।‘’

সেই সময় মক্কা বা মদিনার বাসিন্দারা কয়েকটি তারিখে রোজা রাখতেন। অনেকে আশুরার দিনে রোজা রাখতেন। আবার কেউ কেউ চান্দ্র মাসের ১৩,১৪ ও ১৫ তারিখে রোজা রাখতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোঃ আতাউর রহমান মিয়াজি বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘’অন্যান্য পয়গম্বরদের জন্য রোজা ফরজ ছিল, তবে সেটা একমাস ব্যাপী ছিল না, ছিল আংশিকভাবে।"

"ইসলামের নবীও মক্কায় থাকার সময় চান্দ্র মাসের তিনদিন করে সিয়াম সাধনা করতেন, যা হিসাব করলে বছরে ৩৬ দিন হয়। অর্থাৎ সেখানে আগে থেকেই রোজা রাখার বিধান ছিল।‘’

ইসলামের ইতিহাস উল্লেখ করে তিনি বলেন, নবী আদমের সময় মাসে তিনদিন, নবী দাউদের সময় একদিন পরপর রোজা রাখা, নবী মুসার সময় প্রথমে তুর পাহাড়ে তিনি ৩০দিন রোজা রাখেন। পরবর্তীতে আরও ১০দিন যোগ করে একটানা ৪০ দিন তিনি রোজা রেখেছিলেন।

ইসলামের নবী ৬২২ খৃষ্টাব্দে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার পর মদিনাবাসীকে আশুরার দিনে রোজা রাখতে দেখেন। এরপর তিনিও সেই রোজা রাখতে শুরু করেন।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মোফাচ্ছির এবং উপ-পরিচালক ড. মোঃ আবু ছালেহ পাটোয়ারী বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘’পূর্ববর্তী নবীদের ওপর ৩০ রোজা ফরজ ছিল না। কোন কোন নবীর ওপর আশুরার রোজা ফরজ ছিল, কোন কোন নবীর ওপর আইয়ামুল বিজের (চন্দ্র মাসের ১৩,১৪,১৫) রোজা ফরজ ছিল।‘’

তিনি বলছেন, ‘’রসুল (সাঃ) মক্কায় থাকার সময় ফরজ রোজা রাখতেন, এমন তথ্য পাওয়া যায় না। মদিনায় হিজরত করার পরে যখন তিনি দেখলেন যে, মদিনার লোকজন আশুরার তারিখে রোজা রাখছে। তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন যে, তোমরা কেন রোজা রাখো? তারা বলল, এই দিনে মুসা (আঃ)কে আল্লাহ ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন বলে আমরা রোজা রাখি।‘’

‘’নবীজী বললেন, মুসা (আঃ) এর জন্য হলে তো তোমাদের চেয়ে আমি বেশি হকদার। তখন তিনিও রোজা রাখলেন এবং সাহাবীদেরও রাখতে বললেন। সেই সঙ্গে তিনি বললেন, আগামী বছর বেঁচে থাকলে আমি দুই দিনেই রোজা রাখবো।‘’

তবে তিনি নফল রোজা হিসাবে আগে থেকেই আইয়ামুল বিজের বা চাঁদের ১৩.১৪,১৫ তারিখে রোজা রাখতেন বলে বলছেন ড. পাটোয়ারি।

ইসলাম ধর্মের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নবী আদমের সময় আইয়ামুল বিজের (চান্দ্র মাসের তিনদিন) রোজা রাখা হতো। আরেক নবী মুসার আমলে আশুরার রোজা রাখা হতো। আরব দেশগুলোতে এই দুই ধরনের রোজা রাখার চল ছিল। তবে ৩০ দিনের রোজা শুধুমাত্র ইসলামের নবী মোহাম্মদের আমল থেকে ফরজ করা হয়।

ড. মোঃ আবু ছালেহ পাটোয়ারী বলছেন, এই দুই রোজাই ইসলামের নবী নফল হিসাবে রাখতেন। হিজরি দ্বিতীয় বর্ষের আগে ফরজ (বাধ্যতামূলক) হিসাবে কোন রোজা রাখেননি।

হিজরি দ্বিতীয় বর্ষে বা ৬২৪ খৃষ্টাব্দে কোরানের আয়াতের মাধ্যমে মুসলমানদের জন্য রোজা ফরজ করা হয়।

তবে বিশেষ কোন ঘটনা বা পরিস্থিতির কারণে রোজা বাধ্যতামূলক করা হয়নি। বরং ইসলামের বিধিবিধানের অংশ হিসাবেই সেটা ফরজ করা হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন।

ড. পাটোয়ারি বলছেন, "কোরানের যে সুরা বা আয়াতগুলো ইসলামের নবীর মক্কায় থাকার সময় নাজিল হয়েছে, সেগুলোয় আকিদা, ইমান, একাত্মবাদের বিষয় গুরুত্ব পেয়েছে। আবার মদিনায় নাজিল হওয়া সুরাগুলোয় ধর্মের নানা বিধিবিধান নাজিল হয়েছে। তার একটি হচ্ছে রোজা।"


রোজার নিয়মে পরিবর্তন

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মোফাচ্ছির এবং উপ-পরিচালক ড. মোঃ আবু ছালেহ পাটোয়ারী বলছেন, ''প্রাথমিক অবস্থায় রোজা ধাপে ধাপে সহনীয় করে তোলা হয়েছিল। রোজা ফরজ করা হলেও কেউ যদি মনে করতেন যে, তিনি রোজা রাখতে পারবেন না, ইচ্ছা করলে তিনি ফিদইয়া দিয়ে দিতে পারতেন। (এর অর্থ হলো প্রতিটা রোজার বিনিময়ে নির্দিষ্ট পরিমাণের জম বা তার মূল্য গরিবদের দান করে দেয়া।) "

"এটা সাময়িকভাবে কিছুদিন ছিল, তবে পরবর্তীতে সেটা সবার ফরজ করে দেয়া হয় যে, রোজার মাস উপস্থিত হলে সবাইকে রোজা রাখতে হবে।‘’

ড, পাটোয়ারী বলছেন, ‘’এরপরে আবার আল্লাহ পাক নির্দেশ দিলেন, সন্ধ্যা থেকে এশার আজানের মধ্যবর্তী সময়ে খাবার-দাবার বা অন্যসব কাজ করতে হবে। এশার আজান হয়ে গেলে পরের দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত আর খাওয়া যেতো না। কিন্তু এতেও সাহাবীদের অনেকের কষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। খাবার খেতে খেতে এশার আজান হয়ে গেছে।"

"এরকম দুইটি ঘটনা ঘটে। এরপর আল্লাহ পাক, তাদের কষ্টের কথা বুঝে আয়াত নাজিল করলেন যে, এখন থেকে সুবেহ সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজা রাখবে। এই বিধানটি পরবর্তীতে চূড়ান্ত হয়ে গেছে,’’ বলছেন মোফাচ্ছির ড. মোঃ আবু ছালেহ পাটোয়ারী।

এইসব পরিবর্তন দ্বিতীয় হিজরিতেই রোজা ফরজ করার রমজান মাসেই হয়েছিল।

সেই সময় রোজা শুরুর আগে ও পরে মূলত খেজুর, পানি, মাংস ও দুধ খাওয়া হতো বলে ইতিহাসবিদরা জানিয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী শিক্ষা বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলছেন, তখন আরবের মানুষ সেহরি এবং ইফতারে অনেকটা একই ধরনের খাবার খেতেন, যার মধ্যে রয়েছে খেজুর, জমজমের পানি। কখনো কখনো উট বা দুম্বার দুধ এবং মাংসও খাওয়া হতো।


ইসলামি ধর্মীয় বিধান প্রণয়নে ১৩ গবেষক

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২২ জানুয়ারি, ২০২৪

ইসলামি ধর্মীয় বিধান প্রণয়নে ১৩ গবেষক

JlecBD ডেস্ক: দ্বিতীয় শতাব্দীর শুরু থেকে চতুর্থ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়কাল হলো ইজতিহাদ (ধর্মীয় বিধান প্রণয়নে গবেষণামূলক প্রয়াস)-এর স্বর্ণযুগ। ইজতিহাদের ঊষালগ্নে ১৩ জন মুজতাহিদ ছিলেন। তাদের সংক্ষিপ্ত জীবনালেখ্য উল্লেখ করা হলো

১. ইমাম সুফিয়ান বিন উয়াইনা (রহ.), [জন্ম : ২৫ ডিসেম্বর, ৭২৫ খ্রিস্টাব্দ, মৃত্যু : ২৫ ফেব্রুয়ারি, ৮১৫ খ্রিস্টাব্দ]

তিনি একজন বিদগ্ধ মুহাদ্দিস, হাফেজ এবং ফকিহ (ইসলামি আইন বিশেষজ্ঞ) এবং মুহাদ্দিসদের মধ্যে অগ্রগণ্য, যারা নবী কারিম (সা.)-এর হাদিস বিন্যস্ত ও সম্পাদনার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন। তিনি সেই অন্যতম ব্যক্তি ছিলেন, যাকে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) কুফায় হাদিস বর্ণনার সুযোগ দিয়েছিলেন এবং তার মুহাদ্দিস হওয়ার নেপথ্যে ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর নিরলস প্রচেষ্টা ও প্রয়াস সর্বত্র স্বীকার্য। তার অন্যতম কৃতিত্ব হলো, তিনি কোরআন শরিফের আক্ষরিক এবং শব্দার্থিক চিহ্নগুলোকে কাগজের পাতায় নিয়ে এসেছেন। তার ইজতিহাদ ও ফিকাহ সংক্রান্ত তথ্য জানার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, তিনি ফিকাহ শাস্ত্রের অন্যতম ব্যক্তিত্ব ইমাম শাফেয়ি (রহ.)-এর শিক্ষক ছিলেন।

২. ইমাম মালেক বিন আনাস (রহ.), [জন্ম : ৭১১ খ্রিস্টাব্দ, মৃত্যু : ৭৯৫ খ্রিস্টাব্দ]

তিনি ‘ইমামু দারিল হিজরত’ উপাধিতে সমাদৃত এবং ইমামে মদিনা ও ইমামে আহলে হেজাজ উপাধিতে সুপরিচিত। এই মুজতাহিদ (গবেষক, প্রণেতা) ও ফকিহ প্রথমে হাদিস ও আইনশাস্ত্রের জ্ঞান অর্জন করেন প্রথমে রাবিয়া রায়ি (রহ.)-এর থেকে, তারপর ইবনে হরমুজ (রহ.)-এর কাছ থেকে। তার শিক্ষকদের মধ্যে অন্যতম হলেন ইমাম ইবনে শিহাব যুহরি (রহ.)। ‘আল মুদাওওয়ানাতুল কুবরা’ ও ‘মুয়াত্তা মালেক’ নামের দুই বিখ্যাত কিতাবের রচয়িতা এই ফকিহ মাজহাবে মালেকির প্রবর্তক।

৩. ইমাম হাসান বসরি (রহ.), [জন্ম : ৬৪২ খ্রিস্টাব্দ, মৃত্যু : ৭২৮ খ্রিস্টাব্দ]

নবী কারিম (সা.)-এর ঘরে উম্মাহাতুল মুমিনিন উম্মে সালমা (রা.)-এর কোলে বড় হওয়া এই ফকিহের আসল নাম হাসান বিন ইয়াসার। তার মা ছিলেন হজরত উম্মে সালমা (রা.)-এর ক্রীতদাসী। তিনিই নাম রাখেন ‘হাসান’ এবং কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে, হজরত উমর ফারুক (রা.) তার নামকরণ করেছেন। তার পিতা ইয়াসার ছিলেন হজরত যায়েদ বিন হারেস (রা.)-এর ক্রীতদাস। তিনি ‘ইমামুল আউলিয়া’ ও ‘ইমামুল মুহাদ্দিসিন’ উপাধিতে ভূষিত ছিলেন। প্রত্যেক যুগের আলেমরা ইমাম হাসান বসরি (রহ.)-কে তাফসির, হাদিস, ফিকহ ও তরিকতের ইমাম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। হজরত বিলাল ইবনে আবি বুরদা (রহ.) বলেন, ‘আমি হাসান বসরির চেয়ে সাহাবায়ে কেরামের মতো সাদৃশ্যপূর্ণ আর কাউকে পাইনি।’

৪. ইমামে আজম আবু হানিফা (রহ.), [জন্ম : ৬৯৯ খ্রিস্টাব্দ, মৃত্যু : ৭৬৭ খ্রিস্টাব্দ]

হজরত ইমাম আজম (রহ.)-এর নাম নোমান এবং উপাধি আবু হানিফা। তিনি ৮০ হিজরিতে ইরাকের কুফা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম সাবিত, পিতামহ নোমান বিন মারযুবান ছিলেন কাবুলের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের অন্যতম। তার প্রপিতামহ মারযুবান পারস্যের একটি অঞ্চলের শাসক ছিলেন। তার পিতামহ পিতা সাবিতকে শৈশবে হজরত আলি (রা.)-এর খেদমতে নিয়ে আসেন। হজরত আলি (রা.) তার জন্য বরকতের দোয়া করেন। সেই দোয়া এমনভাবে কবুল হয় যে, ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর মতো মহান মুহাদ্দিস, ফকিহ ও আবিদ ও জাহিদ ব্যক্তিত্বের জন্ম হয়। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি সুসংহত পদ্ধতিতে আইনশাস্ত্রের (ফিকহ) ভিত্তি স্থাপন করেছেন।

তিনি মাজহাবে হানাফির প্রবর্তক। হজরত মালেক বিন আনাস (রা.) বলেন, ‘ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ৬০ হাজার মাসয়ালা প্রণয়ন করেছেন।’ হজরত আবু বকর বিন আকিক বলেন, ‘ইমাম আবু হানিফা ৫ লাখ মাসয়ালা প্রণয়ন করেছেন।’ খতিব খাওয়ারজিমি বলেন, ‘ইমাম আবু হানিফা ৩ লাখ মাসয়ালা প্রণয়ন করেছেন। তন্মধ্যে ৩৮ হাজার ইবাদত-বন্দেগি সংশ্লিষ্ট এবং অবশিষ্ট মাসয়ালা লেনদেন ও আচার-আচরণ ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট।’

৫. ইমাম সুফিয়ান সাওরি (রহ.), [জন্ম : ৭১৬ খ্রিস্টাব্দ, মৃত্যু : ৭৭৮ খ্রিস্টাব্দ]

বিদগ্ধ ফকিহ ও মুহাদ্দিস ইমাম সুফিয়ান সাওরি (রহ.) হাদিস সংরক্ষণ, বিন্যস্ত এবং বর্ণনায় এতটাই খ্যাতি অর্জন করেছিলেন যে, শোবাহ বিন হাজ্জাজ, সুফিয়ান বিন উয়াইনা এবং ইয়াহিয়া বিন মঈন (রহ.)-এর মতো জগদ্বিখ্যাত মুহাদ্দিসরা তাকে ‘আমিরুল মুমিনিন ফিল হাদিস’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেছিলেন। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) তার জ্ঞান ও শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে অবগত ছিলেন। তিনি বলেন, সে যদি তাবেইনদের যুগে হতো তাহলে তারও একটি বিশেষ অবস্থান

থাকত। বলা হয়, সমসাময়িক আইনশাস্ত্রে তার চেয়ে বেশি হালাল-হারামের বিষয়ে জানতেন এমন কেউ ছিল না। তাবেইনদের মধ্যে যাদের ফিকাহ ও হাদিসের ইমামদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলা হতো, তাদের একজন হলেন ইমাম সুফিয়ান সাওরি (রহ.)।

৬. ইমাম আওযায়ি (রহ.), [জন্ম : ৭০৭ খ্রিস্টাব্দ, মৃত্যু : ৭৭৪ খ্রিস্টাব্দ]

সিরিয়ার ইসলামি আইনশাস্ত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ ফকিহ হলেন হজরত ইমাম আওযায়ি (রহ.)। তার আসল নাম আবদুল আজিজ, যা তিনি পরিবর্তন করে আবদুর রহমান রাখেন। তিনি দামেস্কের শহরতলি আল-আওযার বাসিন্দা। ৮৮ হিজরিতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন এবং ইয়ামামায় শিক্ষাজীবন শেষে সেখানে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। এরপর তিনি বৈরুতে যান এবং সেখানেই ইন্তেকাল করেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বাগ্মী ও সাহিত্যিক এবং সিরিয়ার জনগণের মধ্যে তার শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকৃত। আল্লামা যাহাবি (রহ.) তাকে শাইখুল ইসলাম এবং হাফেজ উপাধিতে ভূষিত করেছেন। ইমাম আবু যুরআহ (রহ.) বলেন, ইমাম আওযায়ি (রহ.) ফিকাহ শাস্ত্রের অনেক কিতাব রচনা করেছেন যা ঈর্ষণীয় এবং তিনি ছিলেন সিরিয়ার জনগণের আস্থাভাজন ও গ্র্যান্ড মুফতি।

৭. ইমাম শাফেয়ি (রহ.), [জন্ম : ৭৬৭ খ্রিস্টাব্দ, মৃত্যু : ৮২০ খ্রিস্টাব্দ]

ইমাম শাফেয়ি (রহ.)-এর পুরো নাম মুহাম্মদ বিন ইদ্রিস বিন আল আব্বাস বিন উসমান বিন শাফি আল-কুরাইশি আল-হাশিমি আল-মুত্তালিবি। ১৫০ হিজরিতে ফিলিস্তিনের গাজায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ২০৪ হিজরিতে মিসরে মৃত্যুবরণ করেন। গাজায় তার বাবার মৃত্যুর পর ২ বছর বয়সে তার নিজের জন্মভূমি মক্কায় নিয়ে আসেন। ফলে তিনি মক্কায় বেড়ে ওঠেন ও পড়াশোনা করেন। শৈশবে পবিত্র কোরআন মুখস্থ করে মেধার স্বাক্ষর রাখেন। এরপর আরবের অন্যতম অভিজাত গোত্র হুজাইলে চলে যান। সেখানে আরবি কবিতা ও কাসিদা মুখস্থ করেন এবং আরবি সাহিত্যে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেন। মক্কার বড় মুফতি মুসলিম বিন খালিদের শ্রেষ্ঠ ছাত্রের কৃতিত্ব লাভ করেন। তিনি যখন ফতোয়া দেওয়ার অনুমতি দেন, তখন তার বয়স মাত্র ১৫। এরপর তিনি মদিনায় এসে ইমাম মালেক (রহ.)-এর কাছ থেকে ফিকাহ অধ্যয়ন করেন এবং মুয়াত্তার দরস নেন। তিনি মাত্র ৯ দিনে ‘মুয়াত্তা’ মুখস্থ করেন। একইভাবে তিনি সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা, ফাজিল ইবনে আইয়াদ এবং স্বীয় চাচা মুহাম্মাদ ইবনে শাফি (রহ.)-এর থেকে হাদিস বর্ণনা করেন। ২০০ হিজরিতে তিনি মিসরে হিজরত করেন এবং সেখানে তিনি নতুন মাজহাব প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ২০৪ হিজরিতে রজবের শেষ শুক্রবার মিসরে ইন্তেকাল করেন। তার রচিত সংকলনের মধ্যে রয়েছে, ‘আল রিসালাহ’ যা উসুলে ফিকাহ বিষয়ে রচিত এবং ‘আল-উম’ তার বিখ্যাত কিতাব যাতে তার নতুন মাজহাব ‘মাজহাবে শাফেয়ি’-এর কথা উল্লেখ রয়েছে।

৮. ইমাম লাইছ বিন সাদ (রহ.), [জন্ম : ৭১৩ খ্রিস্টাব্দ, মৃত্যু : ৭৯১ খ্রিস্টাব্দ]

মুহাদ্দিস, মুফাসসির, আলেম এবং ফকিহ ইমাম লাইছ বিন সাদ (রহ.) হিজরি দ্বিতীয় শতাব্দীতে মিসরসহ ইসলামি পণ্ডিতদের শিক্ষক হিসেবে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। হাদিস ও ফিকাহ শাস্ত্রে তিনি ছিলেন তার যুগের অগ্রগণ্য আলেমদের একজন। ওই সময়ে প্রায় সব হাদিস বিশারদ তার ছাত্র হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। ইমাম নববি (রহ.) বলেন, তিনি হাদিস ও ফিকহের ইমাম ছিলেন। পরিতাপের বিষয় হলো, যদি তার ছাত্ররা তার ইজতিহাদ এবং ফিকাহ বিষয়ক মাসয়ালাসমূহ লিখে রাখতেন, তাহলে তিনিও মুজতাহিদ ইমামদের মধ্যে পরিচিতি পেতেন। এ কারণেই ইমাম শাফেয়ি (রহ.) বলেন যে, তার ছাত্ররা তাকে ইতিহাসের পাতা থেকে নিশ্চিহ্ন করেছে অর্থাৎ তারা তার ইলমসমূহ লিপিবদ্ধ করেননি।

৯. ইমাম ইসহাক বিন রাহাবিয়া (রহ.), [জন্ম : ৭৭৮ খ্রিস্টাব্দ, মৃত্যু : ৮৫৩ খ্রিস্টাব্দ] তাবেইনদের সাহচর্যে যারা ধন্য হয়েছেন এবং দ্বীনি শিক্ষার উন্নয়ন ও প্রসারে যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তাদের অন্যতম হলেন ইসহাক বিন রাহাবিয়া (রহ.)। তৎকালীন আলেম এবং তার সম-সাময়িকরা তার জ্ঞান ও প্রজ্ঞার স্বীকৃতি দিয়েছেন। তিনি শুধু জ্ঞান ও হাদিসের ক্ষেত্রেই উচ্চ পদমর্যাদা অর্জন করেননি বরং অন্যান্য ক্ষেত্রেও যেমন তাফসির, ফিকাহ, উসুলে ফিকাহ, সাহিত্য ও ভাষা, ইতিহাস-সংস্কৃতি এবং নাহু-সরফেও পারদর্শী ছিলেন। ইমাম খতিবে বাগদাদি (রহ.) [মৃত্যু ৪৬৩ হি.] বলেন, ইমাম ইসহাক বিন রাহাবিয়া (রহ.) হাদিস ও ফিকাহশাস্ত্রে পারদর্শী ছিলেন। তিনি যখন কোরআনের তাফসির করতেন, তখন তিনি তাতেও সনদ উল্লেখ করতেন। ইমাম ইসহাক বিন রাহাবিয়া (রহ.) নিজেই একজন মাজহাব প্রণেতা এবং মুজতাহিদ ছিলেন। তিনি হানাফি, মালেকি, হাম্বলি ও শাফেয়ি নামক কোনো মাজহাবের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। ইবনে কাসির (রহ.) (৭৭৪ হি.) বলেন, ইসহাক বিন রাহাবিয়া ছিলেন সেই সময়ের একজন ইমাম। একটি দল তার মতানুসারে ইস্তিম্বাত (বাছাই) ও ইজতিহাদ করত। ফিকাহ শাস্ত্রের ওপর তার লিখিত গ্রন্থ ‘কিতাবুস সুনান ফিল ফিকহ’ অন্যতম।

১০. ইমাম আবু সাওর (রহ.), [জন্ম : ৭৬৪ খ্রিস্টাব্দ, মৃত্যু : ৮৬০ খ্রিস্টাব্দ]

তার পুরো নাম আবু সাওর ইবরাহিম বিন খালিদ বিন আবি আল-ইয়ামান আল-কালবি আল-বাগদাদি। ইবনে হিব্বান (রহ.) তার সম্পর্কে বলেন, তিনি তাদের মধ্যে অন্যতম একজন ইমাম ছিলেন যে, সব ইমাম ফিকহ, ইলম, তাকওয়া ও সততার ক্ষেত্রে পুরোবিশ্বে রাজত্ব করেছেন। তিনি তাদের মধ্যে একজন ছিলেন, যারা এসব বিষয়ে কিতাব সংকলন করেছিলেন এবং সুন্নাহের উৎকর্ষ সাধন করেছিলেন।

১১. ইমাম মুহাম্মদ (রহ.), [জন্ম : ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ, মৃত্যু : ৮০৫ খ্রিস্টাব্দ]

ইমাম মুহাম্মাদ বিন হাসান আশ-শাইবানি ছিলেন তাবেঈ-তাবেইনদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ইমাম শাফেয়ি (রহ.)-এর শিক্ষক এবং ইমামে আজম আবু হানিফা (রহ.)-এর শিষ্য ও বিশেষ উপদেষ্টা। ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.)-এর পরে তিনি ছিলেন সেরা ছাত্র। শিক্ষকের চিন্তাধারা ও মতাদর্শ লিপিবদ্ধ করার ক্ষেত্রে তার কঠোর পরিশ্রম বর্ণনাতীত। ফিকহে হানাফির প্রথম সংকলক হিসেবে তিনি সুপ্রসিদ্ধির চূড়ায় আরোহণ করেন। এ ছাড়া তিনি বিদগ্ধ মুজতাহিদ ও মুয়াত্তার রাবি ছিলেন। একজন খ্রিস্টান পণ্ডিত তার সর্বাধিক প্রসিদ্ধ কিতাব ‘আসল’ অধ্যয়ন করে (যা মাবসূত নামে পরিচিত) মন্তব্য করেন, এটি আপনার ছোট্ট মুহাম্মদের গ্রন্থের যদি এত মর্যাদা হয়! তাহলে আপনার বড় মুহাম্মদের কীর্তি কেমন হবে? পরে ওই পণ্ডিত ইসলাম গ্রহণ করেন। ইমাম শাফেয়ি (রহ.) বলেন, আমি হালাল-হারাম ও নাসেখ-মানসুখ সম্পর্কে অধিক জ্ঞানের অধিকারী ইমাম মুহাম্মদ (রহ.)-এর চেয়ে আর কোনো বড় আলেম দেখিনি। তার রচিত ৬টি কিতাবকে ফিকাহের পরিভাষায় ‘কুতুবে সিত্তাহ’ বলা হয়। ওই ৬ কিতাব হলো আসল বা মাবসুত, জামেউস সাগির, সিয়ারুস সাগির, জামিউল কাবির, সিয়ারুল কাবির ও যিয়াদাত।

১২. ইমাম দাউদ জাহরি (রহ.), [জন্ম : ৮১৫ খ্রিস্টাব্দ, মৃত্যু : ৮৮৪ খ্রিস্টাব্দ]

তার পুরো নাম দাউদ বিন আলি বিন খালাফ জাহরি (রহ.)। ইসলামি ইতিহাসের স্বর্ণযুগের অন্যতম মুফাসসির, মুহাদ্দিস এবং ইতিহাসবেত্তা এই আলেম আহলে সুন্নাহর মুজতাহিদ আলেমদের একজন। তার খ্যাতির প্রধান কারণ হলো, ফিকহি মাজহাবে একটি নতুন মানহাজ বা মাসলাক অর্থাৎ ফিকহে জাহরি প্রতিষ্ঠা করা। ইবনে হাযম আল-আন্দুলুসি বলেন, তিনি ইসফাহানি উপাধিতে পরিচিত ছিলেন, কারণ তার মায়ের জন্মভূমি ছিল ইসফাহান এবং তার পিতা ছিলেন একজন হানাফি।

১৩. ইমাম ইবনে জারির তাবারি (রহ.), [জন্ম : ৮৩৯ খ্রিস্টাব্দ, মৃত্যু : ৯২৩ খ্রিস্টাব্দ]
পুরো নাম আবু জাফর মুহাম্মদ বিন জারির বিন ইয়াজিদ আল-তাবারি (ইবনে জারির আল-তাবারি)। আব্বাসীয় যুগের একজন বিখ্যাত মুফাসসির ও ইতিহাসবেত্তা। তাবারিস্তানের বাসিন্দা হওয়ার কারণে তাবারি নামকরণ হয়। এলাকাটি যা মাজেন্দ্রান অঞ্চলের অন্তর্গত বর্তমান ইরান। ইমাম তাবারি (রহ.)-এর কিতাবসমূহের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং জনপ্রিয় হলো তাফসিরগ্রন্থ ‘জামিউল বায়ান আন তাবিল’ (আল-কোরআন) এবং ‘তারিখুল রাসুল ওয়াল মুলুক।’ আগেরটি তাফসিরে তাবারি এবং পরেরটা তারিখে তাবারি নামে পরিচিত। তিনি ফিকহে শাফেয়ির অনুসারী ছিলেন, কিন্তু পরে তার মতামত ও ফতোয়ার ওপর ভিত্তি করে একটি মাসলাক প্রতিষ্ঠিত হয়- যা তারই নাম অনুকরণে জারিরি নামে পরিচিত।

তবে কালের আবর্তে তাদের অধিকাংশের মাজহাব হারিয়ে গেছে। সেগুলোর ইতিহাস-ঐতিহ্য শুধু বইয়ের পাতাতেই শোভা পায়। বর্তমান বিশ্বে প্রভাবশালী চারটি মাজহাবই (হানাফি, মালেকি, শাফেয়ি ও হাম্বলি) সর্বজনীনভাবে গৃহীত।

উল্লেখ্য, ফিকাহ হলো, আল্লাহপ্রদত্ত বিধানসমূহের সুবিন্যস্ত রূপ। এটি কোনো ফকিহের (ইমাম) নিজস্ব মনগড়া মতামত নয়। তাদের নিজেদের মনগড়া মতামত প্রদানের কোনো অনুমতি নেই; বরং তারা কেবল কোরআন-হাদিসে সুপ্ত আইনসমূহকে উম্মতের সামনে বিন্যস্ত করে প্রকাশ করেছেন। মাসয়ালা ও ফতোয়াগুলোকে কোনো নির্দিষ্ট ফকিহ ইমাম আবু হানিফা বা ইমাম মালেক বা ইমাম শাফেয়ি রাহিমাহুমুল্লাহুর দিকে সাধারণত এ জন্যই সম্বন্ধ করা হয় যে, তারা সেগুলো প্রকাশ ও উদঘাটন করেছেন, এ জন্য নয় যে এগুলো তাদের বানানো মতামত।




কবর জিয়ারতের দোয়া ও নিয়ম

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০৬ এপ্রিল, ২০২৪

কবর জিয়ারতের দোয়া ও নিয়ম

কবর মানুষকে মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। মৃত্যুর চিন্তা আত্মাকে বিদগ্ধ করে। ভেসে ওঠে পরকালীন জীবন তথা জান্নাত কিংবা জাহান্নামের কথা। যা মানুষকে দুনিয়া বিমুখতা এনে দেয় এবং আখিরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।  মানুষের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তার আমলনামা বন্ধ হয়ে যায়। তাই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাাইহি ওয়া সাল্লাম মৃত ব্যক্তির প্রতি সাওয়াব পাঠানোর আবেদন হিসেবে সাহাবিদের কিছু দোয়া শিখিয়েছেন। যা তারা কবর জিয়ারতের সময় পড়তেন।

ফলে পরকালমুখী জীবনযাপনের প্রতি মানুষ আত্মতাড়িত হয়। একই সঙ্গে তাওবা করে গুনাহমুক্ত থেকে বেঁচে থাকার মানসিকতা তৈরি হয়। আগ্রহ জন্মে সৎ আমলের প্রতি। ইসলামের শুরুর দিকে কবর জিয়ারতের অনুমতি না থাকলেও পরে হজরত মুহাম্মদ (সা.) কবর জিয়ারতের অনুমতি দেন।

কবর জিয়ারতের নিয়ম

কবরস্থানে সর্বপ্রথম জিয়ারতের দোয়া পড়া। এরপর কবরবাসীর ইসালে সওয়াবের নিয়তে দরুদ শরিফ ও বিভিন্ন সুরা ইত্যাদি আদায় করা। মৃতের বা কবরবাসীর মাগফিরাতের জন্য দোয়া করা।

কবর জিয়ারতের ফজিলত

হাদিসে কবর জিয়ারতের ক্ষেত্রে কিছু সুরার বিশেষ ফজিলতের কথা উল্লেখ আছে। এমনকি দরুদ শরিফের ফজিলতের কথাও রয়েছে। তাই দরুদ শরিফ, সুরা ফাতিহা, সুরা ইখলাস, আয়াতুল কুরসি ও অন্য যেসব সুরা সহজ মনে হয়, সেগুলো আদায় করা।

ঈদের নামাজের পর কবরস্থানে যে দোয়া করবেন

কবর জিয়ারত করা বছরের যে কোনো দিন যেকোনো সময় জায়েজ আছে। তবে কেউ যদি বিশেষ কোনো দিন বা রাতকে জিয়ারতের জন্য নির্ধারণ করে নেয় এবং সবসময় সেভাবেই করে তাহলে তা বিদ’আত হিসেবে পরিগণিত হবে।

যেমন দু ঈদের দিন, জুমার দিন, শবে কদর বা কথিত শবে বরাতের ইত্যাদি।

কবর জিয়ারতের সুন্নতি নিয়ম হলো, প্রত্যেক ব্যক্তি যার যখন সুবিধা হবে তখন কবরের সন্নিকটে গিয়ে কিবলামুখী হয়ে দুই হাত উত্তোলন করে অথবা না করে মৃত ব্যক্তিদের জন্য দোয়া করবে। এর আগে কবরে গিয়ে সালামের সুন্নতি দোয়া পাঠ করবে।

উল্লেখ্য যে, অধিক বিশুদ্ধ মতানুসারে মহিলাদের জন্য কবরস্থানে গিয়ে কবর জিয়ারত করা ঠিক নয়। তবে তারা বাড়ি থেকেই মৃতদের জন্য দোয়া করবে।

কবর সামনে রেখে দুই হাত তুলে দোয়া করা উচিত নয়। তাই কবরকে পেছনে রেখে কিংবা কবরের দিকে পিঠ দিয়ে এরপর কিবলামুখী হয়ে দোয়া করতে হবে। আবার কেউ চাইলে হাত না তুলে মনে মনেও দোয়া করতে পারেন, তাতে জিয়ারত হয়ে যাবে।

সুনানে ইবনে মাজাহতে উল্লিখিত এক হাদিসে তিনি বলেন, ‘তোমাদের কবর জিয়ারতে নিষেধ করেছিলাম। এখন থেকে কবর জিয়ারত করো। কেননা, তা দুনিয়া বিমুখতা এনে দেয় এবং আখিরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।’

কবর জিয়ারতের দোয়া

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনার কবরবাসীর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় যে দোয়াটি তিনি পাঠ করেন তা হলো—

السَّلاَمُ عَلَيْكُمْ يَا أَهْلَ الْقُبُورِ يَغْفِرُ اللَّهُ لَنَا وَلَكُمْ أَنْتُمْ سَلَفُنَا وَنَحْنُ بِالأَثَرِ

বাংলা উচ্চারণ : ‘আসসালামু আলাইকুম ইয়া আহলাল কুবুর; ইয়াগফিরুল্লাহু লানা ওয়ালাকুম, আনতুম সালাফুনা ওয়া নাহনু বিল আছার।’

অর্থ : হে কবরবাসী! তোমাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। আল্লাহ আমাদের এবং তোমাদের ক্ষমা করুন, আমাদের আগে তোমরা কবরে গেছ এবং আমরা পরে আসছি। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ১০৫৩)

আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) একটি কবর জিয়ারতে গিয়ে বলেন,

السَّلامُ عَلَيْكُمْ دَارَ قَوْمٍ مُؤمِنينَ وإِنَّا إِنْ شَاءَ اللَّهُ بِكُمْ لاحِقُونَ

বাংলা উচ্চারণ : আসসালামু আলাইকুম দার ক্বাওমিম মুউমিনি না ওয়া ইন্না ইনশাআল্লাহু বিকুম লাহিকুনা। 

অর্থ : মুমিন ঘরবাসীর ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। ইনশাআল্লাহ, আমরা আপনাদের সঙ্গে মিলিত হবো। (সহিহ মুসলিম : ২৪৯)

হাদিসে এসেছে, হজরত বুরায়দা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের এ দোয়া শিক্ষা দিতেন; যখন তারা কবর জিয়ারাতে বের হতেন-

اَلسَّلاَمُ عَلَيْ أَهْلِ الدِّيَارِ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ وَ الْمُسْلِمِيْنَ وَ يَرْحَمُ اللهُ الْمُسْتَقْدِمِيْنَ وَ الْمُسْتَأْخِرِيْنَ وَ اِنَّا اِنْ شَاءَ اللهُ بِكُمْ لَلَاحِقُوْنَ

উচ্চারণ: আসসালামু আলা আহলিদদিয়ারি মিনাল মুমিনিনা ওয়াল মুসলিমিনা ওয়া ইয়ারহামুল্লাহুল মুসতাক্বদিমিনা ওয়াল মুসতাখিরিনা ওয়া ইন্না ইনশাআল্লাহু বিকুম লালাহিকুন। (মুসলিম, মিশকাত)

অর্থ: মুমিন ও মুসলিম কবরবাসীদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। আমাদের মধ্য থেকে যারা আগে (মারা) গেছেন এবং যারা পরে (মারা) যাবেন, তাদের ওপরও আল্লাহ দয়া করুন। আল্লাহর ইচ্ছায়, আমরাও শিগগিরই তোমাদের সঙ্গে মিলিত হবো।

اَلسَّلاَمُ عَلَيْكُمْ أَهْلَ الدِّيَارِ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ وَ الْمُسْلِمِيْنَ وَ اِنَّا اِنْ شَاءَ اللهُ بِكُمْ لَلَاحِقُوْنَ نَسْأَلُ اللهَ لَنَا وَ لَكُمُ الْعَافِيْةَ

উচ্চারণ: আসসালামু আলা আহলাদদিয়ারি মিনাল মুমিনিনা ওয়ালমুসলিমিনা ওয়া ইন্না ইনশাআল্লাহু বিকুম লালাহিকুনা নাসআলুল্লাহা লানা ওয়া লাকুমুল আ’ফিয়াতা। (মুসলিম, মিশকাত)

অর্থ: মুমিন ও মুসলিম কবরবাসীদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। আল্লাহর ইচ্ছায়, নিশ্চয়ই আমরাও শিগগিরই তোমাদের সঙ্গে মিলিত হবো। আমরা তোমাদের জন্য এবং আমাদের জন্য আল্লাহর কাছে নিরাপত্তা প্রার্থনা করছি।

তবে নিচের দোয়াটি বহুল প্রচলিত। হাদিসের সনদের ব্যাপারে অনেকেই এটিকে দুর্বল বলেছেন-

اَلسَّلَامُ عَلَيْكُمْ يَا اَهُلَ الْقُبُوْرِ يَغْفِرُ اللهُ لَنَا وَلَكُمْ اَنْتُمْ سَلَفُنَا وَ نَحْنُ بِالْاَثَرِ

উচ্চারণ: আসসালামু আলাইকুম ইয়া আহলাল কুবুরি ইয়াগফিরুল্লাহু লানা ওয়া লাকুম; আংতুম সালাফুনা ওয়া নাহনু বিলআছারি।

অর্থ: হে কবরবাসী! তোমাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। আল্লাহ তোমাদের এবং আমাদের ক্ষমা করুন। তোমরা আমাদের অগ্রগামী আমরা তোমাদের অনুগামী।

কবরের কথা স্মরণ হলে কিংবা কবরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এ দোয়া করা মুসলিম উম্মাহর জন্য জরুরি। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে নিজের এবং মৃত ব্যক্তির কল্যাণ কামনায় দোয়াগুলো পড়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।