JlecBD: এক নারী অন্তঃসত্ত্বা। তার প্রসববেদনা শুরু হয়েছে। এমন সময়ে মাথায় পিস্তল ধরে আছেন রণবীর কাপুর। তিনি ‘অ্যানিমেল’ সিনেমার ‘হিরো’!
একের পর এক রেকর্ড ভেঙে বলিউডের বক্স অফিস দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সন্দীপ রেড্ডি ভাংগা পরিচালিত ও রণবীর কাপুর অভিনীত ছবি ‘অ্যানিমেল’। সিনেমাটি বাংলাদেশের দর্শকও দেখছেন সিনেমা হলে। মধ্যপ্রাচ্যে ‘অ্যানিমেল’ সিনেমার যে সংস্করণ চলছে, বাংলাদেশেও সেই সংস্করণ সেন্সর পেয়েছে। ‘অ্যানিমেল’ সিনেমায় রণবীর কাপুরের চরিত্রের নাম ‘রণবিজয় সিং’। তিনি সিনেমার নায়ক। এখন আলোচনার বিষয় হলো, রণবীর ‘অ্যানিমেল’ সিনেমায় যে ধরনের পুরুষের চরিত্রে অভিনয় করেছেন, সে ধরনের পুরুষকে কি কোনো নারীর ভালোবাসা উচিত?
স্ত্রীর গলা চেপে ধরে, অকারণ নির্মম ও নৃশংসভাবে মানুষকে হত্যা করে—এই হলো হিরোর চরিত্র বিজয়! সিনেমার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অত্যন্ত রাগী, ইচ্ছেমতো যৌনাচারে লিপ্ত, বিধ্বংসী, নারীবিদ্বেষী একটা চরিত্র। নারীবিদ্বেষকে দেখানো হচ্ছে ‘আলফা মেল’ চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে। ২০২৩ সালে দাঁড়িয়ে এমন চরিত্রকে ‘পৌরুষের অধিকারী’ হিসেবে দেখানো হচ্ছে, যার মধ্যে মানবিকতাবোধ এবং স্বাভাবিক মানুষের যেসব বৈশিষ্ট্য থাকা উচিত, সেসবের ছিটেফোঁটাও নেই। এ যেন আধুনিক যুগে দাঁড়িয়ে আদিমকালে ফিরে যাওয়া। অনেকেই ফেসবুকে স্ট্যাটাসে প্রশ্ন তুলেছেন, ‘এটা কি আদিকাল? আমরা কি জঙ্গলে বাস করি? উগ্র পুরুষতান্ত্রিক পুরুষ দর্শককে খুশি করে জঘন্যভাবে টাকা উপার্জনের সস্তা রাস্তা!’
সন্দ্বীপ রেড্ডি ভাংগা যখন বিজয় দেবরাকোন্ডা অভিনীত ‘অর্জুন রেড্ডি’ সিনেমার জন্য সমালোচিত হয়েছিলেন, তাঁর পুরুষ চরিত্রকে বলা হয়েছিল ‘ভায়োলেন্ট’, তখন তিনি বিনোদন সাংবাদিক অনুপমা চোপড়াকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘ওরা (সমালোচনাকারীরা) ভায়োলেন্সের দেখেছে কী? পরের সিনেমায় আমি দেখাব, “ভায়োলেন্ট পুরুষ” কাকে বলে।’ সেটাই ঘটল।
‘অ্যানিমেল’ সিনেমার মতো পুরুষতান্ত্রিক দুনিয়ার সিনেমা যেভাবে শারীরিকভাবে শক্তিশালী, অত্যন্ত রাগী, সহিংস, একরোখা, নিয়ন্ত্রণহীন চরিত্রগুলোকে নায়ক হিসেবে তুলে ধরে হাততালি কুড়াচ্ছে, সমাজে তা পৌরুষত্ব সম্পর্কে ভুল দিচ্ছে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকে।
একটি ভাইরাল ফেসবুক স্ট্যাটাসে রণবীরের সিনেমার সঙ্গে বাঙালি সংগীত তারকা অনুপম রায়ের প্রসঙ্গও উঠে এসেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনুপমের নানা পোস্ট, ছবি, ক্যাপশন, ভিডিও ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছে বন্ধুর সঙ্গে প্রাক্তন স্ত্রীর বিয়ের বিষয়টি তিনি মেনে নিতে পারছেন না, তিনি ভালো নেই। তখন তাঁকে একপক্ষ অভিযুক্ত করছে এই বলে যে ‘অনুপম তো ম্যানলি না’।
অনেকেই বলছেন, এর পেছনে রণবীরের এই চরিত্রটির মতো বলিউডের সিনেমার এই ধরনের ‘লার্জার দ্যান লাইফ’, ‘রাফ অ্যান্ড টাফ’ পুরুষ চরিত্রগুলোরও দায় রয়েছে।জ্বলন্ত সিগারেটও হয়ে উঠেছে পৌরুষের প্রতীক! হৃৎপিণ্ডে অস্ত্রোপচারের পরও গির্জার ভেতর বিজয়ের হাতে সিগারেট! যেন নিয়মকানুন, মানবিকতা, স্বাভাবিকতার কোনো বালাই–ই নেই।
সিনেমায় নারী চরিত্রগুলোকে অতিথি চরিত্র বললেও ভুল হবে না। পুরুষময় একটা চলচ্চিত্র, যেখানে কোনো পুরুষই আবার ‘স্বাভাবিক’ নয়। বাড়াবাড়ির চূড়ান্ত। শাহরুখ খানের ভক্তরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলছেন, ‘শাহরুখ খান রণবীর কাপুরের চেয়ে অনেক বড় মাপের অভিনেতা, কেননা, তাঁকে কোনো দিন মুখে নারীদের সম্মানের কথা বলে চূড়ান্ত নারীবিদ্বেষী সিনেমায় অভিনয় করে ক্যারিয়ার গড়তে হয়নি। এগুলো স্রেফ ভণ্ডামি!’
আদিমকালে মানুষ অনেকটা নগ্ন হয়ে বনজঙ্গলে শিকার করে বেড়াত। তাদের ভেতর পেশিশক্তিতে যে এগিয়ে থাকত, সে হতো ‘আলফা মেল’। নারীরা তাঁর সঙ্গে সন্তান উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নিত। এই ধারণায় নৈতিকতা বা মৌলিক মানবিকতার কোনো স্থান নেই। সভ্যতা শুরুর আগের সেই ধারণাই ধার করা হয়েছে বিজয়ের চরিত্রায়নে। দুর্বল স্টোরিটেলিং ঢাকা হয়েছে মাত্রাতিরিক্ত সহিংসতা, বিরক্তিকর আর প্রাপ্তবয়স্ক সব দৃশ্য দিয়ে।
অথচ নেতৃত্বগুণের সঙ্গে পেশির সম্পর্ক নেই, সম্পর্ক মেধার ও মননের। যাঁর মানবিক গুণাবলি কর্মের ভেতর দিয়ে অন্য সবাইকে ছাড়িয়ে যায়, তিনিই হন মহানায়ক। একজন নারীর আদর্শ জীবনসঙ্গী তিনিই, যিনি তাঁর সেরা বন্ধু, গল্প করার মানুষ, আবেগীয় নির্ভরতার পরম জায়গা, যিনি আপনাকে প্রতিনিয়ত আপনার ‘সেরা ভার্সন’ হয়ে উঠতে অনুপ্রাণিত করেন, যিনি ক্ষমা করতে জানেন, দুঃসময়টা যাঁর কাঁধে ভর করে সহজে পার করে ফেলা যায়। কিন্তু সুস্থ–স্বাভাবিক সম্পর্কের জন্য রণবীর কাপুরের ‘অ্যানিমেল’ সিনেমায় দেখানো পুরুষেরা ‘বিগ নো’, ‘রেড ফ্ল্যাগ’।
সিনেপ্লেক্স থেকে ‘অ্যানিমেল’ দেখা বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এক নারী দর্শকের কাছে জানতে চাওয়া হয়, এই সিনেমায় রণবীর কাপুরের মতো পুরুষ চরিত্রকে তিনি সঙ্গী হিসেবে চান কি না। তিনি বলেন, ‘প্রশ্নই আসে না। ও তো আসলে অসুস্থ। ছোটবেলায় বাবার ভালোবাসা, মনোযোগ, যত্ন কিছুই না পাওয়ার ফলে মানসিকভাবে বিগড়ে যাওয়া ভয়ংকর একটা চরিত্র। তার বেড়ে ওঠাটা যদি ঠিকভাবে হতো বা ট্রমাগুলো সারিয়ে তোলার জন্য যদি ঠিকভাবে মানসিক চিকিৎসা করা হতো, তাহলে হয়তো চরিত্রটা এমন হতো না। আমার মনে হয় এই সিনেমার পরিচালকও “অ্যানিমেল” সিনেমায় দেখানো পুরুষ চরিত্রের মতো মানসিকভাবে অসুস্থ। সিনেমায় নারীদের যেভাবে দেখানো হয়েছে, তা এই সময়ে দাঁড়িয়ে কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।’
ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস ভাইরাল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ‘আপনি যদি ভাবেন যে দুনিয়ায় আপনার স্বামীই সবচেয়ে খারাপ, তাহলে “অ্যানিমেল” দেখুন। ভালো লাগবে। মনে মনে শান্তি পাবেন।’